
লন্ডনে সিজদা দিতে গিয়েছিলেন, ওহি নিয়ে এসেছেন, প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে এ ধরনের কথা শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও বাস্তব। আর বলেছেন কে? ড. ইউনূসের অন্যতম নিয়োগকর্তা হাসনাত-পাটওয়ারী।
কখন বললেন? যখন ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন, কেউ তা ঠেকাতে পারবে না বলে গতকাল প্রত্যয়ের মতো করে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। বলেন, নির্বাচন ঠেকাতে এলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ করা হবে।
কোনো চাঁদাবাজকে দেশে থাকতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারিও দেন তিনি।
নির্বাচন প্রশ্নে সুজন সম্পাদক ও নির্বাচনবিষয়ক সংস্কার কমিটির বিশিষ্টজন বদিউল আলম মজুমদারের বক্তব্যও আমলে নেওয়ার মতো। এত দিন নির্বাচন বিষয়ে তাঁর কথায় একটু এদিক-সেদিক থাকলেও গতকাল ছিল বেশ স্পষ্টতা। সোজাসাপ্টা বলেন, নির্বাচন নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই।
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়েও কোনো সংকট নেই। বিস্ময়করভাবে এদিনই জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচনের ব্যাপারে কট্টর অবস্থান জানান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণপরিষদ নির্বাচন’ শীর্ষক এক আলোচনায় দলটির নেতারা এ দাবি তোলেন।
অনুষ্ঠানে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী দাবি করেন, বর্তমান সংকট নিরসনের একমাত্র সমাধান গণপরিষদ নির্বাচন।
তিনি বলেই বসেন, ঐকমত্য কমিশনের সময় বাড়ানোর দরকার নেই। ইউনূস সরকার জনগণকে নিয়ে জুলাই সনদ না দেওয়ার মাধ্যমে গাদ্দারি-বেঈমানি করেছে বলেও মন্তব্য তাঁর।
এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুুল্লাহ বলেন, ‘নির্বাচন যেদিন খুশি হোক, কিন্তু নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচন হতেই হবে। বর্তমান সংবিধান টেক্সট বুক অব ফ্যাসিজম। আসন দিয়ে এনসিপিকে কেনা সম্ভব নয়। ’
নির্বাচন সামনে রেখে এর চেয়ে ভয়ানক কথা আর কী হতে পারে? এনসিপির দুই নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ও নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর ড. ইউনূসের উদ্দেশে এ ধরনের কথা কেন জরুরি হয়ে গেল? এর ফের কোথায়? এও কি তাদের কোনো ম্যাটিকুলাসের অংশ?
এর আগে সেনানিবাসে বৈঠক নিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসকে ‘শিষ্টাচারবর্জিত’ বলে মন্তব্য করেছিলেন দলটির মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। ভুল হলে দেশবাসীকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধও করেছিলেন পাটওয়ারী। এবার দুজন একই বক্তব্য দিয়ে বসলেন।
এমনিতেই নাহিদ, হাসনাত, সজীব, সারজিস, পাটওয়ারীদের রাজনৈতিক ঘর-সংসার এনসিপিতে একের পর এক গোলমাল যাচ্ছে। দলীয় কর্মকাণ্ডে হতাশা, অনিয়মের অভিযোগ, না জানিয়ে পদায়ন বা অন্য দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা—এমন নানা কারণ দেখিয়ে গত দুই মাসে দলটি থেকে প্রায় ২৫ নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন।
দলীয় নিবন্ধনকে কেন্দ্র করে গত ১ জুন ঢাকা মহানগর উত্তরে সমন্বয় কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এনসিপির কমিটি গঠন শুরু হয়। এখন পর্যন্ত দেশের ৩৩টি জেলা ও প্রায় ২০০টি উপজেলায় সমন্বয় কমিটি করেছে এনসিপি। এসব কমিটি গঠনের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরিবারের সদস্যকে পদায়ন, কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে অনিয়মসহ নানা অভিযোগ উঠতে থাকে। পরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ও সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগ করেন অনেক নেতা। শুধু সিলেট জেলা থেকেই পদত্যাগ করেন ৯ জন।
গত ৯ আগস্ট মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা সমন্বয় কমিটি থেকে একসঙ্গে পদত্যাগ করেন এনসিপির চার নেতা। এরপর ১০ আগস্ট ফরিদপুরের সমন্বয় কমিটির সদস্য মো. রুবেল মিয়া পদত্যাগ করেন। এনসিপির ফরিদপুর জেলা সমন্বয় কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী সৈয়দা নীলিমা দোলার কাছে দেওয়া পদত্যাগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, সম্প্রতি দলের কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ, দলের সিদ্ধান্ত এবং অবস্থানগুলো জুলাই বিপ্লবের নীতি ও নৈতিকতার পরিপন্থী বলে মনে হওয়ায় এবং দলটির বর্তমান পথচলা তাঁর ব্যক্তিগত আদর্শ ও মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় তিনি গভীরভাবে হতাশ ও বিচলিত। এর আগে ৮ আগস্ট চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা জাতীয় নাগরিক পার্টির সমন্বয় কমিটি থেকে ১ নম্বর যুগ্ম সমন্বয়কারী এ ইউ মাসুদ (আরফান উদ্দিন) পদত্যাগ করেন। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তিনি এ সিদ্ধান্ত জানান। একই দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে দুই নেতা শরীয়তপুর জেলা সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ডামুড্যা উপজেলা কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী তারিকুল ইসলাম এবং জেলা কমিটির সদস্য পলাশ খান পদত্যাগ করেন।
গত ২৯ জুন এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সদস্যসচিব আখতার হোসেন স্বাক্ষরিত মতলব দক্ষিণ উপজেলা শাখার সমন্বয় কমিটি ঘোষিত হয়। এর কিছুক্ষণ পরই ওই কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী ডি এম আলাউদ্দিনকে ‘জাতীয় পার্টির নেতা’ ও ‘ফ্যাসিস্টের সহযোগী’ আখ্যা দিয়ে পদত্যাগ করেন যুগ্ম সমন্বয়কারী হেলাল উদ্দিন। নিজের ফেসবুক আইডি থেকে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
এ ছাড়া ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এবং কেন্দ্রীয় দপ্তরে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে এনসিপি বাগমারা উপজেলা কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন তিন সদস্য—হাদিউজ্জামান রাফি, ফুয়াদ হাসান গানিম ও রাবিউল ইসলাম রাহুল। এনসিপি থেকে পদত্যাগ করেছেন সিলেট জেলা কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী ও জুলাইয়ে নিহত সাংবাদিক এ টি এম তুরাবের ভাই আবুল আহসান জাবুরও। তিনিসহ সিলেটে এনসিপি থেকে ৯ জন পদত্যাগ করেন। গত ১২ জুলাই কমিটি ঘোষণার পরদিন বিশ্বনাথ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা কমিটি থেকে চার নেতা পদত্যাগ করেন। তাঁদের মধ্যে গোয়াইনঘাট উপজেলা কমিটি থেকে সদস্য ফাহিম আহমদ ও যুগ্ম সমন্বয়কারী নাদিম মাহমুদ এবং বিশ্বনাথ উপজেলা কমিটি থেকে যুগ্ম সমন্বয়কারী রুহুল আমিন ও সদস্য শাহেদ আহম্মেদ পদত্যাগ করেন। এ ছাড়া গত ২১ জুলাই গোয়াইনঘাট উপজেলা কমিটি থেকে আরো চার নেতা পদত্যাগ করেন।
এর আগে দল গঠনের পরপরই এনসিপি থেকে পদত্যাগ করেন দলটির তিন কেন্দ্রীয় নেতা যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবু হানিফ, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (উত্তর অঞ্চল) হানিফ খান সজীব ও যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুজ জাহের। পদত্যাগপত্রে তাঁরা ব্যক্তিগত কারণের কথা জানান এবং পদত্যাগের পর আগের দল গণ অধিকার পরিষদে ফিরে যান।
এদিকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ দেখিয়ে এনসিপির মাদারীপুর জেলা ও সদর উপজেলা সমন্বয় কমিটি স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে মাদারীপুর জেলা কমিটির সদস্য মো. আব্দুল্লাহ আদিল ও রাতুল হাওলাদারের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব সাংগঠনিক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে সমন্বয় কমিটি গঠনের মাত্র দুই দিন পর নানা আলোচনা-সমালোচনার মুখে তা স্থগিত করা হয়। এনসিপির বিভিন্ন জেলা, উপজেলার কমিটির সদস্যরা পদত্যাগ করলেও তাঁরা দলীয় কোনো নির্দেশনা মানেননি। পদত্যাগ পাঠানো হয়নি কেন্দ্রীয় দপ্তর সেলে। বেশির ভাগই পদত্যাগ করেছেন ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে। এ ছাড়া শৃঙ্খলাভঙ্গ, নৈতিক স্খলন, বিতর্কে জড়ানোসহ বিভিন্ন ঘটনায় ১০ জন কেন্দ্রীয় নেতাকে গত ছয় মাসে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে এনসিপি। এ রকম অবস্থায় কোন অভিযাত্রার ফেরে পড়লেন হাসনাত-পাটওয়ারীরা?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
Leave a Reply