সারাদিন ঘুম ঘুম পাওয়া কি গুরুতর রোগের লক্ষণ? জেনে নিন

সারাদিন ঘুম ঘুম পাওয়া বা অতিরিক্ত তন্দ্রাচ্ছন্নতা, যাকে চিকিৎসা পরিভাষায় হাইপারসোমনিও (Hypersomnia) বলা হয়, শুধু ক্লান্তি বা পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবের লক্ষণ নাও হতে পারে। এটি বিভিন্ন শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে। যদি আপনার পর্যাপ্ত ঘুম হওয়া সত্ত্বেও দিনের বেলায় অস্বাভাবিক ঘুম ঘুম পায় বা ঘুমানোর প্রবল আকাঙ্ক্ষা থাকে, তবে তা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত।

যেসব কারণে সারাদিন ঘুম ঘুম পেতে পারে:
১. পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব (Sleep Deprivation): এটি সবচেয়ে সাধারণ কারণ। নিয়মিত রাতে পর্যাপ্ত (প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৭-৯ ঘণ্টা) ঘুম না হলে দিনের বেলায় ক্লান্তি ও ঘুম ঘুম পেতে পারে। এর কারণ হতে পারে অনিয়মিত জীবনযাপন, কাজের চাপ, বা দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিন ব্যবহার।

২. স্লিপ অ্যাপনিয়া (Sleep Apnea): এটি একটি গুরুতর ঘুমের ব্যাধি, যেখানে ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস বারবার বন্ধ হয়ে যায় এবং আবার শুরু হয়। এর ফলে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের সরবরাহ কমে যায়, ঘুম ভেঙে যায় (যদিও ব্যক্তি তা টের পান না), এবং ঘুমের মান খারাপ হয়। ফলস্বরূপ, দিনের বেলায় তীব্র ঘুম ঘুম ভাব আসে। নাক ডাকা, দম বন্ধ হয়ে আসা বা সকালে মাথাব্যথা এর সাধারণ লক্ষণ।

৩. নারকোলেপসি (Narcolepsy): এটি একটি ক্রনিক নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার। এতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা দিনের বেলায় হঠাৎ করে ঘুমিয়ে পড়েন, এমনকি কাজের মধ্যেও। এর সঙ্গে পেশীর দুর্বলতা (cataplexy), ঘুমের পক্ষাঘাত (sleep paralysis) বা হ্যালুসিনেশনও থাকতে পারে।

৪. ইডিয়োপ্যাথিক হাইপারসোমনিও (Idiopathic Hypersomnia): এই অবস্থায় ব্যক্তি দীর্ঘক্ষণ ঘুমানোর পরও দিনের বেলায় অতিরিক্ত ঘুম অনুভব করেন। এটি নারকোলেপসির মতো তীব্র নয়, তবে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এর কোনো সুস্পষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।

৫. অবসাদ (Depression): মানসিক অবসাদ ঘুমের ধরনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। কিছু মানুষ অবসাদের কারণে অতিরিক্ত ঘুমায় (হাইপারসোমনিও), আবার কেউ অনিদ্রায় ভোগেন। অবসাদের অন্যান্য লক্ষণ যেমন – মন খারাপ, আগ্রহের অভাব, মনোযোগে সমস্যা, ক্ষুধামন্দা ইত্যাদিও এর সঙ্গে থাকতে পারে।

৬. থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা (Hypothyroidism): থাইরয়েড গ্রন্থি পর্যাপ্ত হরমোন তৈরি না করলে শরীরের বিপাক ক্রিয়া ধীর হয়ে যায়, যা ক্লান্তি, অলসতা এবং দিনের বেলায় অতিরিক্ত ঘুমের কারণ হতে পারে। ওজন বৃদ্ধি, ঠাণ্ডা সহ্য করতে না পারা এবং শুষ্ক ত্বকও এর লক্ষণ।

৭. রক্তস্বল্পতা (Anemia): রক্তে লোহিত রক্তকণিকা বা হিমোগ্লোবিনের অভাব হলে কোষে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছায় না, যার ফলে ক্লান্তি, দুর্বলতা এবং অতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাব দেখা দেয়।

৮. ডায়াবেটিস (Diabetes): রক্তে শর্করার মাত্রা অস্বাভাবিক হলে ক্লান্তি ও তন্দ্রাচ্ছন্নতা দেখা দিতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে শরীর শক্তি উৎপাদনে অক্ষম হয়, যা ঘুমের কারণ হতে পারে।

৯. ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ, যেমন – অ্যান্টিহিস্টামিন, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস, ট্রাঙ্কুলাইজার বা উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ ঘুমের কারণ হতে পারে বা তন্দ্রাচ্ছন্নতা বাড়াতে পারে।

১০. পুষ্টির অভাব: ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি১২, আয়রন বা ম্যাগনেসিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানের অভাবও ক্লান্তি ও ঘুমের কারণ হতে পারে।

কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?
যদি আপনি দিনের বেলায় নিয়মিতভাবে অতিরিক্ত ঘুম ঘুম অনুভব করেন, এমনকি পর্যাপ্ত ঘুম হওয়ার পরও, অথবা যদি এটি আপনার দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটায়, তবে অবিলম্বে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চিকিৎসক আপনার লক্ষণগুলো পর্যালোচনা করে এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক কারণ নির্ণয় করতে পারবেন এবং উপযুক্ত চিকিৎসার সুপারিশ করবেন।

অতিরিক্ত ঘুম ঘুম পাওয়া একটি অন্তর্নিহিত রোগের লক্ষণ হতে পারে, তাই এটিকে উপেক্ষা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আপনার স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*