
হিজরি ১৪৪৭ এর নতুন বছরের সূচনায় পবিত্র কাবার গিলাফ (কিসওয়া) পরিবর্তন করা হয়েছে। বুধবার (২৫ জুন) আসরের নামাজের পর এই কাজ শুরু হয় এবং বৃহস্পতিবার সকালে তা সম্পন্ন হয়।
আরব নিউজের খবরে বলা হয়েছে, কিসওয়া একটি কাফেলার মাধ্যমে মসজিদুল হারামে আনা হয়। কাবার উপরের অংশে কিসওয়ার প্রতিটি অংশ আলাদাভাবে তোলা হয়, তারপর নিচে নামানো হয় এবং পুরনো গিলাফ সরানো হয়। এই প্রক্রিয়া চারবার পর্যায়ক্রমে পুনরাবৃত্তি করা হয়, যতক্ষণ না নতুন গিলাফ পুরোপুরি বসানো হয় এবং পুরনোটি পুরোপুরি অপসারণ করা হয়।
এর আগে, একটি সুসজ্জিত বিশেষ ট্রাকে করে গিলাফ কাবা প্রাঙ্গণে আনা হবে। গিলাফ পরিবর্তনের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা কাবা ঘিরে রাখেন।
কাবার গিলাফ পরিবর্তনের দৃশ্য ‘মক্কা লাইভ চ্যানেল’-এর মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
ইসলামের প্রথম যুগ থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন ধরে জিলহজ মাসের ৯ তারিখ (আরাফা দিবস) কাবার গিলাফ পরিবর্তনের নিয়ম প্রচলিত ছিল। ২০২২ সালে সৌদি সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, হিজরি নববর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে গিলাফ পরিবর্তন করা হবে ১ মহররম; নতুন বছরের শুরুতে বা প্রথম রাতে। এরপর গত কয়েক বছর যাবত ১ মহররম গিলাফ পরিবর্তন করা হচ্ছে।
কাবায় গিলাফ পরানোর প্রচলন: কাবাকে সর্বপ্রথম কে গিলাফ পরান এ বিষয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেক মনে করেন, কাবাকে সর্বপ্রথম গিলাফ পরিয়েছিলেন ইসমাইল (আ.)। আবার কেউ কেউ মনে করেন, রাসুলুল্লাহর (সা.) পূর্বপুরুষ আদনান প্রথম কাবাকে গিলাফ পরান। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হলো, ইয়েমেনের বাদশাহ তুব্বা আবু কারব আসআদ—যিনি হিমইয়ার গোত্রের একজন শাসক—কাবাকে সর্বপ্রথম গিলাফ পরিয়েছিলেন।
আবু কারব আসআদের যুগে এবং এরপর বেশ কিছু কাল কাবাকে মিশরের তৈরি কাপড় ‘কিবাতি’ দিয়ে আচ্ছাদন করার করা হতো। পরে কাবাকে ‘বুর্দ’ (বিশেষ ধরনের কাপড়) দিয়ে ঢাকার নিয়ম চালু হয়। কাবাকে রেশমি ‘দিবাজ’ কাপড়ের গিলাফ প্রথম পরান মক্কায় উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিকের নিয়োগকৃত শাসনকর্তা হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ সাকাফি। (তাফসিরে কুরতুবি: ২/ ৮৬)
কাবার গিলাফ যেভাবে তৈরি হয়: কাবার গিলাফ তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় ১০টি ধাপে। শুরুতে রেশম ও সুতার পিণ্ডি সংগ্রহ করে তা ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়। এরপর সুতায় প্রয়োজনীয় রং লাগানো হয় এবং স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে কাপড় বোনা হয়। কাপড় তৈরির পর নিশ্চিত করা হয়, সেটি যেন পুরো বছর স্থায়িত্ব ধরে রাখতে সক্ষম হয়। ৬৫৮ বর্গমিটার আয়তনের গিলাফ তৈরি করতে ব্যবহৃত হয় ৬৭০ কেজি কালো রেশম। ১৬ মিটার দৈর্ঘ্যের বিশ্বের সর্ববৃহৎ সেলাই মেশিনে করা হয় এসব কাজ। কারুকার্যের অনেক কাজ হাতে করা হয়।
পরবর্তী ধাপে ৪৭টি কাপড়ের টুকরাকে বিশেষ মেশিনে সেলাই করে একত্রিত করা হয়। এরপর গিলাফের ওপর মেশিনের সাহায্যে লিখে দেওয়া হয় আল্লাহর নাম ও গুণাবলি: ‘ইয়া আল্লাহ’, ‘ইয়া মান্নান’, ‘ইয়া দাইয়ান’, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’।
এই ধাপ শেষে গিলাফ চলে যায় গিল্ডিং ও এমব্রয়ডারির বিভাগে। সেখানে দক্ষ ক্যালিগ্রাফার ও হস্তশিল্পীরা পরম যত্নে সোনালি বেল্ট এবং কাবার দরজার পর্দা তৈরি করেন। ২৩ থেকে ৬০ বছর বয়সের ৫০ জনেরও বেশি শিল্পী এই কাজে অংশ নেন। তারা কোরআনের আয়াত এবং বিভিন্ন দোয়া এমব্রয়ডারি করেন।
কাবার গিলাফে কাপড়ের ভিন্ন ভিন্ন ৫টি অংশ একত্রে সেলাই করা হয় এবং তামার রিং দিয়ে গোড়ায় স্থির করা হয়। ৪টি টুকরা কাবার চারপাশে লাগানো হয় এবং পঞ্চম টুকরাটি দরজার জন্য ব্যবহার হয়। এসব টুকরাকে পরস্পরের সঙ্গে সেলাই করে সংযুক্ত করা হয়। গিলাফে সুরা ফাতিহা, সুরা ফালাক, সুরা আন-নাস এবং সুরা কুরাইশ লিপিবদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া গিলাফে ১৭টি ছোট ছোট বাতিসদৃশ এমব্রয়ডারি করা থাকে যেগুলোতে আল্লাহর বিভিন্ন নাম খোদাই করা হয়।
এ কাজে ২১ ক্যারেটের ১০০ কেজি খাঁটি রুপা এবং ১২০ কেজি সোনার প্রলেপযুক্ত রুপার সুতা ব্যবহার করা হয়। সেই কাপড়ে লেখা হয় পবিত্র কোরআনের আয়াত ও আল্লাহর গুণবাচক নাম। গিলাফের সব কাজ শেষ করতে ছয় থেকে আট মাস সময় লাগে। সব মিলিয়ে ৮৫০ কেজি ওজনের এই গিলাফ তৈরিতে ব্যয় হয় ২৫ মিলিয়ন সৌদি রিয়াল বা সাড়ে ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই গিলাফকে বিশ্বের ব্যয়বহুল কাপড় বলে মনে করা হয়।
Leave a Reply