
প্রত্যাবাসন নিয়ে চলমান আলোচনা এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাঝেও বাংলাদেশে ঢুকেছে নতুন করে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। সীমান্তবর্তী এলাকায় তাদের আগমন স্থানীয় প্রশাসন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর নতুন ধরনের চাপ তৈরি করছে। ত্রাণ, আশ্রয় এবং মৌলিক সেবা ব্যবস্থা ভারসাম্য রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘস্থায়ী সঙ্কট এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনো বাস্তবায়নযোগ্য নয়।
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে প্রায় সোয়া লাখ রোহিঙ্গা। এদের আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ এবং জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) দ্বারা। বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে অন্তত ১৩ লাখ ২৪ হাজারে। এছাড়া সীমান্তে ২৫-৩০ হাজার রোহিঙ্গা অপেক্ষমাণ অবস্থায় রয়েছেন, যারা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছেন। প্রতি বছর ক্যাম্পে জন্ম নিচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার শিশু।
কক্সবাজারের পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি দিয়ে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে খুনোখুনি, মাদক চোরাচালান এবং সশস্ত্র সংঘাতের ঘটনা বেড়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করছে। দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পগুলো মাদক চোরাচালানের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত সতর্কতা অবলম্বন করছে।
অর্থনৈতিক সহযোগিতাও ধীরে ধীরে কমছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ছয় হাজার ৪০০ অনানুষ্ঠানিক স্কুলে ক্লাস বন্ধ অথবা কমিয়ে আনা হয়েছে। এর ফলে চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শিশুর শিক্ষাজীবন ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার পর উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েক হাজারকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, মংডুসহ কিছু এলাকায় যুদ্ধ এবং নৌবাহিনীর হামলার কারণে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঝুঁকি ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
সীমান্ত সূত্র জানাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আনতে দালাল এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীর চক্র সক্রিয়। আরাকান আর্মি, আরসা ও আরএসও-এর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে এ চক্রের সম্পর্ক রয়েছে। নাফ নদে রোহিঙ্গাদের নৌকাযাত্রা চলাকালীন বিজিবি অনেককে আটক করলেও প্রতিদিনই নতুনদের প্রবেশের চেষ্টা হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চীনের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালে প্রথম পাইলট প্রকল্পে ১,১৪০ জন অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তবে বাস্তবে এখনও কেউ নিজ দেশে ফেরেননি।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, আট বছরেও একজন রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরেনি। অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়নি, অপরাধে জড়িত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বাজেট সহায়তাও অপ্রতুল। চলতি বছর শিক্ষা খাতে প্রয়োজন ৭২ মিলিয়ন ডলার, যা মিলেছে মাত্র ১০ মিলিয়ন। মোট বাজেট চাহিদা ৯৩৪ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৩০৩ মিলিয়ন, অর্থাৎ প্রয়োজনের মাত্র ৩২ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক সহায়তা হ্রাস প্রধান কারণ।
জাতিসংঘের উদ্যোগে সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে রোহিঙ্গা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। তার আগে কক্সবাজারে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের সমস্যা, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এবং বাজেট সহায়তার বিষয় আলোচনা হবে।
শরণার্থীদের নিরাপত্তা, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং নতুন ঢলের চাপ মোকাবেলার প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বাস্তবতা এবং সীমান্তের অপরাধমূলক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক সহায়তা এখন সময়োপযোগী।
টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা তরুণী উম্মে সলিমা (১৮) তার মা সবুরা খাতুনকে নিয়ে কয়েক মাস আগে মিয়ানমারের মংডুর আশিকখ্যাপাড়ার নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তার খালা রমিজা খাতুন কয়েক বছর ধরে লেদা ক্যাম্পে রয়েছেন। সলিমার বাবা মো. হোসেন আরাকান আর্মির হাতে নিহত হয়েছেন।
নির্যাতন ও অস্থিরতা থেকে বাঁচতে সলিমা ও তার পরিবারের সদস্যরা দালালের মাধ্যমে নাফ নদ পাড়ি দিয়েছেন। মুদ্রায় ১০ লাখ টাকা দিয়ে রফিক নামে এক দালালের সাহায্যে যাত্রা শুরু হলেও নদ পাড়ি দেওয়ার আগে ভাইবোনদের হারিয়ে ফেলেন। পরে তারা এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় পান। সলিমার ভাই এনামুল হাসান (১৫) এবং বোন ইসমত আরা (১৩) মা ও বোনের কাছে ফিরে আসতে চাইছেন, তবে অর্থ সংকটের কারণে দালাল ধরতে পারছেন না।
সলিমা বলেন, মগবাগি আর বাপরে মারি ফেইলে। জুলুমের জড়িয়া আর বিড়া বাড়িত ফেরত ন পারি। দুই ভাইবোনের জন্য চিন্তায় আছি। তার মতো লাখো রোহিঙ্গা প্রতিদিন সীমান্ত অতিক্রম করছে।
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, বেশ কিছুদিন ধরেই মিয়ানমারকেন্দ্রিক সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মি, আরসা, আরএসও এবং অন্যান্য গোষ্ঠী মংডু টাউনশিপের কাছে অবস্থান করছে। নাফ অতিক্রমের সময় বিজিবি অনেককে আটক করছে। বিজিবি জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আনতে সীমান্তের দুই পাশে একটি চক্র রয়েছে, যারা অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ করাচ্ছে।
কক্সবাজারের টেকনাফের ২৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সি ব্লকের মাঝি মো. নুর বলেন, রাখাইনে আরাকান আর্মি নির্যাতন চালাচ্ছে। তাদের বাংলাদেশে আনার জন্য দালালদের অর্থ দেওয়া লাগছে। আবার আরাকান আর্মিকে অর্থ না দিলে সীমান্ত অতিক্রম করা যায় না। হাতে টাকা না থাকায় পরিবারের জন্য চিন্তিত।
আট বছর আগে মংডুর কাওয়ারবিল থেকে তিন সন্তানসহ পালিয়ে আসেন আমেনা বেগম। চলতি বছরের শুরুতে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় আবার কক্সবাজারে ফিরতে হয়। তিনি বলেন, নিজ দেশে ফিরতে চাই। ভিটেমাটি ফেলে এসে অন্য দেশ কতকাল থাকব?
বিজিবি বলছে, গত আট মাসে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অন্তত ২৪০ জেলেকে অপহরণ করেছে আরাকান আর্মি। মার্চ থেকে ২৩ আগস্টের মধ্যে অপহৃত হয়েছেন ১৮০ জন। এদের মধ্যে প্রায় ২০০ জনকে ফেরত আনা হয়। সর্বশেষ শনিবার সাগরে মাছ শিকার শেষে ফেরার পথে নৌকাসহ ১২ জেলেকে আটক করা হয়।
পুলিশের সূত্র বলছে, ক্যাম্পে গত আট বছরে অন্তত ৩০০ জন খুন হয়েছেন; মামলা হয়েছে ২৮৭টি। জেলা পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের আট মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ১০ ধরনের অপরাধের বিপরীতে ২৫০টি মামলা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদক ও অপহরণ-সংক্রান্ত।
‘জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান-জেআরপি’ কর্মসূচির আওতায় কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। তবে প্রতিবছর বরাদ্দ কমছে। ২০২৪ সালে ৯০০ মিলিয়ন চেয়ে পাওয়া গেছে ৬০০ মিলিয়ন। ২০২৩ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য চেয়ে মিলেছে এর অর্ধেক।
চীনের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রথম ধাপে ১,১৪০ জন রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৭১১ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের অনুমতি মেলেছে। বাকি ৪২৯ জনের বিষয়ে মিয়ানমারের আপত্তি ছিল।
উম্মে সলিমার মতো হাজার হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের জন্য আশ্রয় ও নিরাপত্তা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অনিশ্চয়তার মধ্যেও প্রতিদিন নতুন ঢল আসছে, যা বাংলাদেশে মানবিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার ওপর নতুন চাপ তৈরি করছে।
Leave a Reply